গাজা দখলের কারণ, ইসরাইলি বিশ্লেষণ এবং সম্ভাবনা

গাজা উপত্যকা, ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরে অবস্থিত একটি ছোট ভূখণ্ড, দীর্ঘদিন ধরে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু। ইসরাইলের গাজা দখলের প্রচেষ্টা এবং এর পিছনে থাকা কারণগুলো বহুমাত্রিক এবং জটিল। এই ব্লগে আমরা গাজা দখলের কারণ, ইসরাইলি দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যতে ইসরাইলের দখলের সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

GazaVsIsrael

গাজা দখলের কারণ

ইসরাইলের গাজা দখলের পিছনে বেশ কয়েকটি কৌশলগত, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত কারণ রয়েছে। এগুলো নিম্নরূপ:

১. নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং হামাসের হুমকি

ইসরাইলের দৃষ্টিকোণ থেকে, গাজা উপত্যকা হামাসের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীর কারণে একটি প্রধান নিরাপত্তা হুমকি। হামাস, যিনি ২০০৭ সাল থেকে গাজার শাসনভার গ্রহণ করেছেন, ইসরাইলের বিরুদ্ধে বারবার রকেট হামলা এবং সীমান্ত আক্রমণ চালিয়েছেন। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণে প্রায় ১,২০০ ইসরাইলি নিহত হয়, যা ইসরাইলের জন্য একটি বড় ধাক্কা ছিল। ফলস্বরূপ, ইসরাইল হামাসকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার লক্ষ্যে গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরাইল কাটজের মতে, গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হামাসকে উৎখাত এবং জিম্মিদের মুক্ত করার জন্য অপরিহার্য।

২. কৌশলগত ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য

গাজা ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত, যা এটিকে ভূ-কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। ইসরাইলের জন্য গাজার নিয়ন্ত্রণ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আধিপত্য বজায় রাখার একটি উপায়। ঐতিহাসিকভাবে, ইসরাইল ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে গাজা দখল করেছিল এবং ২০০৫ সালে সেখান থেকে সেনা প্রত্যাহার করলেও এটি এখনও গাজার সীমান্ত, আকাশসীমা এবং সমুদ্রপথের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। মোরাগ করিডোরের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণ ইসরাইলের জন্য কৌশলগত সুবিধা প্রদান করে, যা তারা সম্প্রতি পুনরায় দখল করেছে।

৩. অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ

ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি গাজা দখলের একটি বড় কারণ। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার কট্টর ডানপন্থী এবং ধর্মীয় জাতীয়তাবাদীদের সমর্থনে টিকে আছে। এই গোষ্ঠীগুলো মনে করে যে ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণরূপে দমন করা এবং গাজা ও পশ্চিম তীরের মতো অঞ্চলগুলো ইসরাইলের অধীনে আনা ঐশ্বরিক এবং ঐতিহাসিকভাবে ন্যায়সঙ্গত। নেতানিয়াহু নিজেও রাজনৈতিক চাপের মুখে গাজায় কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমে জনসমর্থন বাড়ানোর চেষ্টা করেন।

৪. ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা রোধ

ইসরাইলের কিছু নীতিনির্ধারক মনে করেন যে গাজার নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে থাকলে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা কমে যাবে। টু-স্টেট সমাধান, যা ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের পাশাপাশি দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে, অনেক ইসরাইলি নেতার কাছে অগ্রহণযোগ্য। গাজার নিয়ন্ত্রণ তাদের জন্য ফিলিস্তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা দুর্বল করার একটি উপায়।

৫. অর্থনৈতিক ও সম্পদ সংক্রান্ত স্বার্থ

গাজার উপকূলে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে, যা অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ইসরাইলের জন্য গাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এই সম্পদের উপর তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এছাড়া, গাজার পুনর্গঠন এবং নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে ইসরাইলি কোম্পানিগুলোর জন্য ব্যবসায়িক সুযোগ রয়েছে, যদি তারা এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

ইসরাইলি বিশ্লেষণ

ইসরাইলি বিশ্লেষক এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে গাজা দখল নিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এখানে কিছু মূল বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো:

১. হামাস নির্মূলের একমাত্র উপায়

ইসরাইলের সামরিক ও গোয়েন্দা বিশ্লেষকরা মনে করেন যে হামাসের ভূগর্ভস্থ টানেল নেটওয়ার্ক এবং সামরিক অবকাঠামো গাজার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। ইসরাইলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র জোনাথন কারিকাসের মতে, গাজায় হামাসের অবকাঠামো দুটি স্তরে বিদ্যমান—উপরের স্তরে সাধারণ মানুষ এবং নিচের স্তরে হামাস। এই কাঠামো ধ্বংস করতে গাজার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

২. আন্তর্জাতিক সমর্থনের সুযোগ

ইসরাইলের কিছু বিশ্লেষক মনে করেন যে হামাসের হামলার পর ইসরাইল আন্তর্জাতিক সমর্থন পাচ্ছে, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে। এই সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে তারা গাজায় দীর্ঘমেয়াদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে পারে। তবে, এই কৌশলের ঝুঁকি হলো মুসলিম বিশ্ব এবং অন্যান্য দেশের কাছ থেকে তীব্র সমালোচনা এবং সম্ভাব্য কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা।

৩. গণহত্যার অভিযোগ এবং আইনি জটিলতা

ইসরাইলের ক্রিয়াকলাপ গাজায় গণহত্যা হিসেবে বর্ণিত হয়েছে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক আইনজ্ঞদের দ্বারা। ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ইসরাইলি হামলায় ৪০,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার অধিকাংশ নারী ও শিশু। ইসরাইলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বক্তব্যে গাজার জনগণকে "ধ্বংস" করার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, যা গণহত্যার আইনি সংজ্ঞার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই অভিযোগ ইসরাইলের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা এবং নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি তৈরি করেছে।

৪. দীর্ঘমেয়াদী শান্তির সম্ভাবনা

কিছু ইসরাইলি বিশ্লেষক মনে করেন যে গাজার পুনর্দখল দীর্ঘমেয়াদী শান্তির জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তারা টু-স্টেট সমাধানের পক্ষে, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি রাজনৈতিক দিগন্ত তৈরি করতে পারে। তবে, এই দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান সরকারের কট্টর নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ইসরাইল কি গাজা দখল করতে পারবে?

ইসরাইলের গাজা দখলের সম্ভাবনা নির্ভর করে বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর—সামরিক সক্ষমতা, আন্তর্জাতিক সমর্থন, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। এখানে এর সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জগুলো বিশ্লেষণ করা হলো:

১. সামরিক সক্ষমতা

ইসরাইলের সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনীগুলোর একটি। তারা ইতোমধ্যে রাফাহ এবং মোরাগ করিডোরের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দখল করেছে। তবে, গাজার ঘনবসতিপূর্ণ শহুরে এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ এবং হামাসের টানেল নেটওয়ার্ক ইসরাইলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

২. ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ

হামাস এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো ইসরাইলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত, তারা আইইডি হামলা এবং অন্যান্য কৌশল ব্যবহার করে ইসরাইলি অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করছে। এই প্রতিরোধ দীর্ঘমেয়াদী দখলকে জটিল করে তুলতে পারে।

৩. আন্তর্জাতিক চাপ

ইসরাইলের গাজা দখলের প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে। তুরস্ক, সৌদি আরব এবং মিসরের মতো দেশগুলো ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো গণহত্যার অভিযোগ তুলেছে, যা ইসরাইলের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং কূটনৈতিক চাপ বাড়াতে পারে।

৪. মানবিক ও অর্থনৈতিক খরচ

গাজার পুনর্দখল এবং এর পরিচালনা ইসরাইলের জন্য ব্যয়বহুল। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজার পুনর্গঠনে ৫০ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন, যার প্রথম তিন বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার লাগবে। এছাড়া, গাজার মানবিক সংকট—যেমন খাদ্য সংকট এবং হাসপাতালের ধ্বংস—ইসরাইলের জন্য প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।

৫. অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ঝুঁকি

নেতানিয়াহুর সরকারের উপর অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়ছে। ২০২৩ সালের হামাস হামলার জন্য অনেক ইসরাইলি তাকে নিরাপত্তা ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেন। গাজার দীর্ঘমেয়াদী দখল জনসমর্থন হ্রাস এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে।

ইসরাইলের গাজা দখলের পিছনে নিরাপত্তা, ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য, রাজনৈতিক চাপ এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের মতো বিভিন্ন কারণ রয়েছে। ইসরাইলি বিশ্লেষণে এই দখলকে হামাস নির্মূল এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উপায় হিসেবে দেখা হলেও, এটি গণহত্যার অভিযোগ এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পড়েছে। সামরিকভাবে ইসরাইল গাজার নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হলেও, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ, মানবিক সংকট এবং আন্তর্জাতিক চাপ দীর্ঘমেয়াদী দখলকে অত্যন্ত জটিল করে তুলবে। শান্তির জন্য একটি টেকসই সমাধান, যেমন টু-স্টেট সমাধান,ই এই সংঘাতের একমাত্র বাস্তবসম্মত পথ হতে পারে।

Post a Comment

Previous Post Next Post