বাংলাদেশের বিশ্ব বিখ্যাত ২০ জন ব্যক্তি: যাঁরা পৃথিবীর মঞ্চে ইতিহাস রচনা করেছেন

বাংলাদেশ—নদীমাতৃক এই দেশটি শুধু তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য নয়, বরং এর মানুষের অসাধারণ প্রতিভা ও অবদানের জন্যও বিশ্বব্যাপী পরিচিত। সাহিত্যের কবি-সাহিত্যিক থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী, শিল্পী, সমাজ সংস্কারক এবং রাজনীতিবিদ—বাংলাদেশের সন্তানরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের অমর স্বাক্ষর রেখেছেন।

20 world famous people from Bangladesh

আজ আমরা এমন ২০ জন বিশ্ব বিখ্যাত বাংলাদেশি ব্যক্তির গল্প শেয়ার করবো, যাঁরা তাঁদের কাজের মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন। চলুন, তাঁদের জীবনের গল্পে ডুব দিই!

১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

বাংলা সাহিত্যের এই অমর কবি ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’র জন্য নোবেল পুরস্কার জিতে এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী হন। তাঁর কবিতা, গান, নাটক ও উপন্যাস বাংলা সংস্কৃতির প্রাণ। শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। তাঁর কাজ আজও বিশ্বের কাছে বাংলার পরিচয়।

২. কাজী নজরুল ইসলাম

বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুল তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য বিখ্যাত। তাঁর লেখায় শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। গান, গজল ও নাটকেও তিনি অসাধারণ অবদান রাখেন। তাঁর সৃষ্টি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণা ছিল এবং আজও তা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত।

৩. ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ক্ষুদ্রঋণের ধারণা প্রবর্তন করে তিনি বিশ্বে ‘দারিদ্র্য দূরীকরণের নায়ক’ হিসেবে পরিচিত। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি লাখো মানুষের জীবন বদলে দেন এবং ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার জিতেন। তাঁর সামাজিক ব্যবসা মডেল বিশ্বের ৪০টিরও বেশি দেশে অনুকরণ করা হয়।

৪. জিবনানন্দ দাশ

বাংলা কবিতায় আধুনিকতার পথিকৃৎ জিবনানন্দ তাঁর ‘রূপসী বাংলা’ ও ‘বনলতা সেন’-এর মতো কাব্যগ্রন্থে প্রকৃতি ও মানব জীবনের গভীর দর্শন তুলে ধরেন। তাঁর কবিতা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বাংলা সাহিত্যে তাঁর প্রভাব অপরিসীম।

৫. ফজলে হাসান আবেদ

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলেন। তাঁর নেতৃত্বে ব্র্যাক বিশ্বের বৃহত্তম এনজিওতে পরিণত হয়। তিনি ‘নাইট কমান্ডার’ খেতাবসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক সম্মান লাভ করেন।

৬. হুমায়ূন আহমেদ

বাংলা সাহিত্য ও বিনোদন জগতের এই কিংবদন্তি তাঁর ‘হিমু’, ‘মিসির আলি’ সিরিজ ও টিভি নাটকের জন্য বিখ্যাত। তাঁর সহজ-সরল লেখনী বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলে। তিনি একুশে পদক ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।

৭. শামসুর রহমান

বাংলাদেশের শীর্ষ কবি শামসুর রহমান তাঁর কবিতায় শহুরে জীবন, সমাজ ও রাজনীতির প্রতিফলন ঘটান। তাঁর কাজ স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের কবিতার ধারাকে নতুন মাত্রা দেয়। তাঁর কবিতা বিশ্বব্যাপী পঠিত ও প্রশংসিত।

৮. সুফিয়া কামাল

নারী জাগরণের অগ্রদূত সুফিয়া কামাল তাঁর কবিতা ও সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নারী ক্ষমতায়নের পথ দেখান। তিনি একুশে পদক ও বেগম রোকেয়া পদক লাভ করেন। তাঁর কাজ বিশ্বে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করে।

৯. জসীমউদ্দীন

‘পল্লীকবি’ জসীমউদ্দীন তাঁর ‘নকশী কাঁথার মাঠ’ ও ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’-এ গ্রামীণ বাংলার জীবন তুলে ধরেন। তাঁর কবিতা ও গান বাংলা লোকসংস্কৃতির ধারক। তাঁর সৃষ্টি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

১০. জাহানারা ইমাম

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণে লেখা তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অমর দলিল। তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ‘ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন করেন, যা বিশ্বে ন্যায়বিচারের প্রতীক হয়ে ওঠে।

১১. জয়নুল আবেদিন

‘শিল্পাচার্য’ জয়নুল আবেদিন তাঁর ‘মন্বন্তর’ সিরিজের চিত্রকর্মের জন্য বিখ্যাত। তিনি ঢাকায় চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন, যা বাংলাদেশের শিল্পকলার ভিত্তি। তাঁর কাজ বিশ্বের বিভিন্ন গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়।

১২. বেগম রোকেয়া

নারী শিক্ষার পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া তাঁর ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এ নারী ক্ষমতায়নের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। তিনি নারী শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং বাংলা সাহিত্যে অবদান রাখেন। তাঁর কাজ বিশ্বে নারীবাদী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা।

১৩. সৈয়দ মুজতবা আলী

রম্য সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা তাঁর ‘দেশে বিদেশে’ ও ‘চাচা কাহিনী’র জন্য প্রিয়। তাঁর হাস্যরস ও ভ্রমণকাহিনী বাংলা সাহিত্যে নতুন ধারা সৃষ্টি করে। তাঁর লেখা বিশ্বব্যাপী পঠিত।

১৪. এ কে ফজলুল হক

‘শেরে বাংলা’ নামে পরিচিত ফজলুল হক কৃষকদের অধিকার রক্ষায় কাজ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর রাজনৈতিক দর্শন দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব ফেলে।

১৫. মোহাম্মদ আলী বগুড়া

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে অবদান রাখেন। জাতিসংঘে তাঁর ভূমিকা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি তৈরিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।

১৬. সলিমুল্লাহ খান

নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দান করেন এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তাঁর কাজ শিক্ষা ও রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।

১৭. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষক মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ গ্রন্থের জন্য বিখ্যাত। তাঁর কাজ বাংলা ভাষার ঐতিহ্য বিশ্বের কাছে তুলে ধরে।

১৮. সৈয়দ নজরুল ইসলাম

মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নেতৃত্ব বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান জানান দেয়।

১৯. তাজউদ্দীন আহমদ

১৯৭১ সালে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। তাঁর কৌশলগত নেতৃত্ব বাংলাদেশের স্বাধীনতায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

২০. সৈয়দ আলী আহসান

বাংলা সাহিত্যের এই কবি ও শিক্ষাবিদ তাঁর কবিতা ও সাহিত্য সমালোচনার জন্য পরিচিত। তাঁর কাজ বাংলা সাহিত্যের আধুনিক ধারাকে সমৃদ্ধ করে এবং বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়।

কেন তাঁরা আমাদের গর্ব?

এই ২০ জন ব্যক্তি বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী তাঁদের প্রতিভার আলো ছড়িয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বাংলা ভাষাকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছেন, ইউনূস দারিদ্র্য দূরীকরণে নতুন পথ দেখিয়েছেন, আর জয়নুলের মতো শিল্পীরা বাংলার সৌন্দর্যকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছেন। তাঁদের গল্প আমাদের শেখায়, সীমিত সুযোগেও প্রতিভা ও অধ্যবসায় দিয়ে অসাধারণ কিছু অর্জন করা সম্ভব।

এই ব্যক্তিত্বরা বাংলাদেশের গর্ব, বিশ্বের সম্পদ। তাঁদের জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি কীভাবে একজন মানুষ তাঁর স্বপ্ন ও কাজের মাধ্যমে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারে। তাঁদের গল্প আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।

Post a Comment

Previous Post Next Post