শেখ হাসিনা কেন পালিয়ে গেছেন?
শেখ হাসিনা, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তার এই পলায়নের পেছনে মূল কারণ ছিল দেশে সৃষ্ট তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ছাত্র-জনতার ব্যাপক আন্দোলন। এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট ইস্যু—সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার—নিয়ে, কিন্তু পরবর্তীতে এটি সরকারবিরোধী গণআন্দোলনে রূপ নেয়। শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে দুর্নীতি, স্বৈরাচারী শাসন, নির্বাচনে কারচুপি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ জনমনে ক্ষোভের জন্ম দেয়।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে সরকার কঠোরভাবে দমনপীড়ন শুরু করে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সংগঠনগুলোর হাতে শত শত প্রাণহানি এবং হাজার হাজার আহতের ঘটনা ঘটে। এই সহিংসতা জনগণের মধ্যে আরও বেশি ক্ষোভ সৃষ্টি করে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে সেনাবাহিনীও সরকারের পক্ষে দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানায়। এমতাবস্থায়, শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট, ২০২৪ তারিখে হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান। তিনি বর্তমানে ভারতের নয়াদিল্লিতে অবস্থান করছেন বলে জানা যায়। তার পলায়নের কারণ ছিল নিজের জীবনের নিরাপত্তা এবং ক্ষমতা হারানোর পর সম্ভাব্য বিচারের ভয়।
শেখ হাসিনা দেশ থেকে কত টাকা লুটপাট করেছেন?
শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। তবে, তিনি দেশ থেকে ঠিক কত টাকা লুটপাট করেছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন। বিভিন্ন সূত্র এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তার শাসনামলে বিলিয়ন ডলারের সম্পদ বিদেশে পাচার করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের জনপ্রিয় গণমাধ্যম ও বিরোধী দলগুলোর দাবি, শেখ হাসিনার পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা বিদ্যুৎ খাত, ব্যাংকিং সেক্টর, এবং বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্প থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। ২০২১ সালে পানামা পেপারস লিকে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের নাম উঠে আসে, যেখানে তার অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে অর্থ পাচারের অভিযোগ করা হয়। এছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২০১৬ সালে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরির ঘটনায় সরকারের দুর্বল তদারকির সমালোচনা হয়।
কিছু অনুমান অনুযায়ী, শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের হাতে ১০ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে। তবে, এই পরিমাণ যাচাইকৃত নয় এবং এটি বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দাবির ওপর ভিত্তি করে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই অর্থ পাচারের তদন্ত শুরু করেছে, এবং ভবিষ্যতে আরও স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যেতে পারে।
শেখ হাসিনার বিচার কি দেশে হবে?
শেখ হাসিনার বিচারের সম্ভাবনা নির্ভর করছে একাধিক বিষয়ের ওপর। বর্তমানে তিনি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন, এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে হত্যা, দুর্নীতি এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ। ২০২৪ সালের আন্দোলনে শত শত মানুষের মৃত্যুর জন্য তাকে দায়ী করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার, যিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত, শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে, এটি বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তি বা আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হবে। ভারত যদি তাকে আশ্রয় দিয়ে থাকে, তবে তার বিচার বাংলাদেশে হওয়া কঠিন হতে পারে।
এছাড়া, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC)-তে তার বিরুদ্ধে মামলা উঠতে পারে, যদি প্রমাণিত হয় যে তার শাসনামলে গণহত্যা বা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। তবে, এই প্রক্রিয়া দীর্ঘসময় ধরে চলতে পারে। বর্তমানে জনমত এবং রাজনৈতিক চাপের কারণে তার বিচারের দাবি জোরালো হলেও, এটি কবে এবং কীভাবে হবে, তা এখনও অনিশ্চিত।
ছাত্র আন্দোলনের গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে বিস্তারিত
২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হবে। এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, সরকার তা বাস্তবায়ন না করায় ২০২৪ সালে ছাত্ররা আবারও রাস্তায় নামে। প্রথমে এটি শান্তিপূর্ণ ছিল, কিন্তু সরকারের দমননীতি এবং পুলিশি হামলার পর এটি সরকারবিরোধী গণআন্দোলনে রূপ নেয়।
জুলাই মাসে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে। ছাত্ররা "নন-কো অপারেশন" এবং "রাজপথ দখল" কর্মসূচি ঘোষণা করে। সরকার কারফিউ জারি করে, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় এবং পুলিশ-আওয়ামী লীগের সহিংসতায় শতাধিক ছাত্র নিহত হয়। এই ঘটনা জনগণের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। শিক্ষক, শ্রমিক, এমনকি সাধারণ মানুষও আন্দোলনে যোগ দেয়।
আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ঢাকায় লাখো মানুষ সরকারি ভবন দখল করে, এবং শেখ হাসিনার বাসভবন গণভবনে হামলা চালানো হয়। সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ অবস্থান নিলে শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এই আন্দোলনের ফলে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে এবং একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
এই গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের সাহসিকতা এবং ত্যাগ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। এটি প্রমাণ করেছে যে জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটাতে পারে।
শেখ হাসিনার পলায়ন, তার দুর্নীতির অভিযোগ, বিচারের সম্ভাবনা এবং ছাত্র আন্দোলনের গণঅভ্যুত্থান—এই সবই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে, এই বিষয়গুলোর পূর্ণাঙ্গ সমাধান এবং সত্য উদঘাটনের জন্য আরও সময় এবং তদন্ত প্রয়োজন। বর্তমান সরকার এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভবিষ্যতে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।