অতীতে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পিরামিড তৈরি করা হয়েছে। তবে সাধারণত পিরামিড বললেই আমাদের কল্পনায় ভেসে ওঠে মিশরের পিরামিড। হাজার হাজার বছর ধরে মিশরের পিরামিডের ছিল মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় এবং বিস্ময়কর স্থাপনা। সকল ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও বর্তমান যুগে এত বড় নির্মাণ এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন পিরামিড সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। মিশরের রাজাদের উপাধি ছিল ফেরাউনের মৃত্যুর পর তাদের মৃতদেহ মমি পিরামিড এর ভেতর সমাহিত করা হতো। প্রত্যেক ফেরাউনের চেয়ে সেরা পিরামিড তৈরি করতে চাইত মিশরীয় রাজাগণ। কারণ তারা মনে করত ফেরাউনের মৃত্যুর পর মৃতদেহ রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের মতে, পিরামিড ফেরাউনদের পুনর্জন্মের প্রবেশদ্বার। এছাড়া ফেরাউনের মৃত্যুর পর তাদের দেহ সংরক্ষণ করা যাবে ততদিন তারা স্বর্গে সহবাস করবে বলে মনে করত। সে জন্যই হাজার হাজার বছর ফেরাউনদের মৃতদেহ সংরক্ষণ করার জন্য তারা এমন দুর্ভেদ্য চিন্তাভাবনা করত। পিরামিডের স্থায়িত্বের তুলনা করতে একটি আরবি প্রবাদ প্রচলিত আছে তা হলো মানুষকে ভয় পায় আর সময় ভয় পায়। ধারণা করা হয় পিরামিডের প্রথম প্রকৌশলী এবং স্থপতি হলো ইমহোতেপ। তিনি ছিলেন প্রথম পিরামিড নির্মাণকারী। ফেরাউনের মন্ত্রী চিকিৎসাশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিদ্যা পারদর্শী ছিলেন।
মিশরীয়রা পরবর্তীতে তাকে ওষুধের দেবতা হিসেবে পূজা করেছে। মিশরীয় পিরামিড তৈরি করেছে তার অনেকগুলোই ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রথম দিকের পিরামিডগুলোর তুলনায় পরের দিকের পিরামিডগুলো বেশি টেকসই এবং সুরক্ষিত করে নির্মাণ করা হয়েছে। কারণ মিশরীয় সময়ের সাথে সাথে তাদের পিরামিড তৈরির শিল্পে দক্ষ হয়েছে। মিশরের ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় 100 টিরও বেশি পিরামিড রয়েছে। সবচেয়ে বিখ্যাত তিনটি পিরামিডের অবস্থান মালভূমিতে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় পিরামিড গিজার মহা পিরামিড বা খুফুর পিরামিড কি নামে পরিচিত। সবচেয়ে ছোট পিরামিড হল মেনকাপুর পিরামিড। গিজার গোরস্তানের তিনটি পিরামিডের মধ্যে সবচাইতে পুরাতন এবং বড়। এটি রাজাপুর নাতির সমাধি 4700 বছর আগে দ্যা গ্রেট পিরামিড নির্মিত হয়েছিল। সবচেয়ে বড় এই পিরামিড এর আয়তন 6fit যা কেবল ফুটবল মাঠের সমান। 1889 সালের আগ পর্যন্ত প্রায় 5000 বছর ধরে এই ছিল মানুষের তৈরি সবচেয়ে উঁচু স্থাপনা। তৈরি করতে 23 লক্ষ পাথরের ব্যবহার করা হয়েছে। এই ব্লকগুলো প্রায় 500 মাইল দূর থেকে নির্মাণ স্থলে বয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। কি করে 50 টন ওজনের প্রায় ত্রিশ লক্ষ তারা মরুভূমির ভেতর দিয়ে পরিবহন করে নিয়ে এসেছে তা সত্যিই এক বিস্ময়।
পিরামিডগুলো বাইরে থেকে দেখতে নিরেট মনে হলেও এগুলো ভেতরে তেমন নয়। পিরামিডের ভেতরে বহু পথ এবং গোপণ কুঠুরি বা চেম্বার হয়েছে। পিরামিডের ভেতরে তিনটি চেম্বার আছে। সেগুলো হলো রানীর চেম্বার এবং রাজার চেম্বার। 300 ফুট দীর্ঘ তিন ফুট প্রস্থের নিরেট পাথর কেটে চেম্বারগুলোর প্রবেশ পথ তৈরি করা হয়েছে। স্বাধীনতাকামীদের কেন্দ্রীয় চেম্বারে ফারাওদের মৃতদেহ রাখা হয়। পিরামিডে বেশ কিছু গোপন পথ এবং সুরঙ্গ রয়েছে। যার রহস্য এখনো সমাধান করা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হয়, গ্রেট পিরামিড নির্মাণ করতে 23 বছর সময় লেগেছিল। 20 থেকে 50 হাজার দক্ষ শ্রমিক কাজ করেছে। পিরামিডের বাইরের এক একটি পাথরের ব্লকের ন্যূনতম ওজন একটি প্রাইভেটকারে সমান। আর ভেতরের একটি ব্লকের ওজন 40 টি প্রাইভেট কার সমান ভারী পাথর দিয়ে নির্মাণ করার কারণে পিরামিডের ওজন অনেক বেশি। বর্তমান সময়ের সর্বোচ্চ ভবন বুর্জ খলিফার ওজনের প্রায় 12 গুণ। বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রেন দিয়ে সর্বোচ্চ ওজন 100 মিটার পর্যন্ত তোলা যায় অথচ তারা এত ভারী পাথর প্রায় দেড়শ মিটার উচ্চতায় তুলে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে জোড়া দিয়েছে যা সত্যিই বিস্ময়কর। পিরামিডের বাইরের দেয়াল তৈরি করা হয়েছে চুনাপাথরের ব্লক দিয়ে। তার মূল্যবান গ্রানাইট পাথর দিয়ে ভেতরের চেম্বার তৈরি করা হয়েছে।
আধুনিক মেশিন দিয়ে পাথর কাটার প্রযুক্তির সাথে পিরামিডের পাথরকাটা অবিশ্বাস্য রকমের মিল রয়েছে। তবে বর্তমানকালের আধুনিক যন্ত্র দিয়েও এত সুন্দর আর নিখুঁতভাবে পাথরকাটা সম্ভব নয়। সময়ের সাথে সাথে তাদের পাথরকাটা প্রযুক্তি যত উন্নত হয়েছে। পিরামিডগুলো টেকসই হয়েছে পিরামিডের ভেতরের পাথরগুলো নিখুঁতভাবে কেটে একটির সাথে আরেকটি এমনভাবে জোড়া দেওয়া হয়েছে। পাথরের মাঝে এক ছিল ফাঁকা নেই ফলে হাজার হাজার বছর ধরে বাইরে থেকে কোন প্রাণী বা আর্দ্রতা পিরামিডের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। ভেতরে ব্যবহৃত গ্রানাইট পাথর গুলো আর্দ্রতা প্রতিরোধী। সে কারণে ফেরাউনের মমি এখানে সুদীর্ঘকাল অক্ষত রেখেছে। আধুনিককালের বিল্ডিং গুলোতে এডমিশন ব্যবহার করা হয়। তা কয়েক শ' বছরের বেশি স্থায়ী হয় না অথচ পিরামিডের পাথরগুলো জোড়া দিতে এমন বিশেষ ধরনের ব্যবহার করা হয়েছে যা 5000 বছর পরেও পাথরগুলোকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। পিরামিডের আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হলো এগুলো নক্ষত্রপুঞ্জের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্মাণ করা হয়েছে। ঊষা মেজর এবং নক্ষত্রমন্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা সাথে মিল রেখে পিরামিডগুলো উত্তর-দক্ষিণ বরাবর স্থাপন করা হয়েছে। তাদের উত্তর দক্ষিণ কোন পরিমাপ এতটাই নিখুঁত ছিল যে 0.05 ডিগ্রির ব্যবধান নির্ণয় করতে পারত।
পিরামিড নিয়ে সুদীর্ঘকাল গবেষণা করেও এর রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব হয়নি। দ্বাদশ শতাব্দীতে সুলতান সালাউদ্দিন এর পুত্র সুলতান আল আজিজিয়া মিশরের পিরামিড ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিল। পাশে থাকা সবচেয়ে ছোট পিরামিড দিয়ে তিনি তার উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেন। কিন্তু বহু অর্থ খরচ করে এবং দীর্ঘ আট মাস কঠোর পরিশ্রম করেও সুলতানের কর্মীরা পিরামিডের খুব বেশি ক্ষতি করতে পারেনি। এরপর বাধ্য হয়েই উচ্ছেদ অভিযানে বন্ধ করে দেওয়া হয়। আসলে পিরামিড কে নিয়ে অনেক ধরনের জল্পনা-কল্পনা রয়েছে সকলের মাঝে। এ সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এখনো বিদ্যমান রয়েছে মিশরের পিরামিড।